রাসেলস ভাইপার সাপের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে গোয়ালন্দের চরাঞ্চলের মানুষ

রাসেলস ভাইপার সাপের কামড়ে তিন কৃষক মৃত্যু বরণ করায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার চরাঞ্চলের মানুষ। ভয়ে অনেকেই ফসল ক্ষেতে যেতে চাচ্ছেন না। ফলে ক্ষেত থেকে ফসল তুলতে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত না হয়ে কৃষকদের বিশেষ ধরণের জুতা পায়ে দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে ধান কাটা ও অন্যান্য কৃষি কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, গোয়ালন্দ উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী উজানচর ইউনিয়নের চর মজলিশপুর, মহিদাপুর, দেবীপুর ও দৌলতদিয়া ইউনিয়নের চর করনেশনা, আংকের শেখের পাড়াসহ চরাঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রব দেখা দিয়েছে। পুরো চরাঞ্চলজুড়ে রাসেলস ভাইপার সাপের কারণে কৃষকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে বিসাক্ত এ সাপের কামড়ে তিন কৃষক মৃত্যু বরণ করায় এসব এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই ফসলের ক্ষেতে যেতে চাচ্ছেন না এবং ধান, ভুট্টা কাটতে শ্রমিকও পাচ্ছে না।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, গত ৮ এপ্রিল চর মজলিশপুর এলাকায় ক্ষেত থেকে ভুট্টা তোলার সময় সাঈদুল শেখ নামের এক কৃষককে সাপে কামড় দেয়। তাকে প্রথমে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক সপ্তাহ পর তিনি মারা যান। এর আগে ২৯ মার্চ চর দেবীপুর মাঠে ময়না বেগম নামের এক কিষানিকে সাপে কামড়ায়। চিকিৎসা নেওয়ার প্রায় দুই সপ্তাহ পর নিজ বাড়িতে মারা যান ময়না বেগম।
মজলিশপুর এলাকার মাতুব্বর আজিজুল মোল্যা জানান, গত ২৭ মে দুপুরে কৃষক শামীম শেখসহ কয়েকজন মাছ ধরার জন্য পদ্মা নদী থেকে একটি নৌকা টেনে তীরে তুলছিলেন। নৌকার নিচে থাকা রাসেলস ভাইপার সাপ শামীমের পায়ে কামড় দেয়। লোকজন সাপটি মেরে তাকে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। পরদিন বিকেলে শামীম মারা যান। এর দুইদিন পর ধান কাটার সময় কৃষকেরা আরেকটি রাসেলস ভাইপার পিটিয়ে মেরে ফেলেন। যার কারণে এখন ভয়ে কেউ মাঠে নামতে সাহস পাচ্ছে না।
আলামিন নামে এক মুদি দোকানদার জানান, কয়েকদিন আগে তিনি দোকান খুলে জিনিসপত্র গোচ্ছাছিলেন। এমন সময় তিনি পানের ডালা উচুঁ করলে একটি সাপ মাথা বের করে। সাপটি ডালার নিচে পেছানো ছিল। এসময় তিনি লাফ দিয়ে দোকান থেকে নেমে যান। পরে সাপটি নিচে নামলে স্থানীয়রা সাপটি পিটিয়ে মেরে ফেলে। এ ঘটনার পর অনেক লোকজন সাপটি দেখতে আসে এবং অধিকাংশ লোকজনই সাপটি রাসেলস ভাইপার বলে জানায়।
উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য শেখ রাসেল মাহমুদ বলেন, পুরো চরাঞ্চলজুড়ে রাসেলস ভাইপার সাপের কারণে কৃষকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মাঝেমধ্যে কৃষকেরা সাপ দেখে পিটিয়ে মেরে ফেলে মাটিতে পুঁতে ফেলছেন। প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
উপজেলা আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ শরিফুল ইসলাম বলেন, গত মার্চ মাসে একজন, এপ্রিলে একজন ও মে মাসে দুজন সাপে কাটা রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। মাঝেমধ্যে সাপে কাটা রোগী হাসপাতালে আসছেন। এখন পর্যন্ত গোয়ালন্দ হাসপাতালে কেউ মারা যায়নি। তাছাড়া আমাদের হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীদের অ্যান্টিভেনাম ইনজেকশন রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, রাসেলস ভাইপার অত্যন্ত বিষধর প্রজাতির সাপ। এ সাপে কামড় দিলে কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন মুখ দিয়ে অতিরিক্ত লালা ঝরতে পারে, প্রসাবের সাথে রক্ত বের হতে পারে। তার ঘাড় নেতিয়ে যেতে পারে। রক্ত জমাট বেঁধে যায়। অনেক সময় চোখের পর্দাও পড়ে যায় এবং কিডনি ফেইলুর হয়ে রোগী মারা যাতে পারে। তবে এ সাপে কামড়ানো রোগীকে যদি দ্রুত হাসপাতালে আনা হয় তাহলে পর্যাপ্ত চিকিৎসার মাধ্যমে অনেকে ক্ষেত্রেই রোগী সুস্থ হয়ে যায়।


গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র বলেন, আমরাও জানতে পেরেছি উজানচর ইউনিয়নের চর মজলিশপুর ও মহিদাপুর চরাঞ্চলের কৃষি ক্ষেতে সাম্প্রতিক সময়ে রাসেলস ভাইপারের মতো বিষধর সাপের উপদ্রব দেখা দিয়েছে। সাপের কামড়ে এরমধ্যেই তিনজন কৃষক মারা গেছে এবং আরো একজন কৃষক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। আমরা হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেমন সংরক্ষণ করেছি। যাতে সাপে কাটা রোগী চিকিৎসা নিতে পারে। এছাড়াও কৃষকদের মাঝে ১০০ গামবুট বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি একজন সাপ বিশেষজ্ঞ নিয়ে এসে কৃষক সমাবেশ করবো। সেখানকার কৃষকরা যাতে রাসেলস ভাইপার থেকে মুক্ত থাকাতে পারে সেজন্য তাদের বিভিন্ন কলা কৌশল সম্পর্কে অবহিত করা হবে।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মার অববাহিকা ধরেই রাসেলস ভাইপার গোয়ালন্দের চরাঞ্চলে এসেছে। পরে তা পাশের এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে। ঘন ঝোপ আর পরিত্যক্ত জমি অপেক্ষাকৃত কমে যাওয়ায় এই সাপ কৃষি জমিতেই থাকে, যার ফলে যারা মাঠে কৃষিকাজ করেন তারা রাসেলস ভাইপারের দংশনের শিকার হচ্ছেন।

+ There are no comments

Add yours