প্রচন্ড মনোবল ও ইচ্ছা শক্তি থাকলে একজন নারী হয়েও অসম্ভবকে সম্ভব করা যায় তার অনন্য দৃষ্টান্ত লজি বেগম (৪৫)। এক সময়ে সংসারে টাকার অভাবে গরুর দুধ কিনতে না পেরে দুধের বোতলে ভাতের মাড় ভরে ছেলেকে খাইয়েছেন। সেই লজি বেগম এখন অন্যের শিশুকে গরুর দুধ খাওয়ান, দুধ খাওয়ান এতিমখানার শিশুদেরও। এখন আর সংসারে অভাব নেই। নিজের চেষ্টায় হয়েছেন স্বাবলম্বী। অভাবকে জয় করে জমিজমাও করেছেন তিনি। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় কোটি টাকা। জীবনের এই পথপরিক্রমায় পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক, জয়িতা পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার। কিন্তু ফেলে আসা সেই দুর্দিনের স্মৃতি বিশেষ করে বোতলে ভরে ছেলেকে ভাতের মাড় খাওয়ানোর কথা আজো ভোলেননি তিনি।
লজি বেগমের বাড়ী রাজবাড়ী সদর উপজেলার দাদশী ইউনিয়নের ছোট নুরপুর গ্রামে। এ প্রতিবেদকের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে জীবন যুদ্ধে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা তুলে ধরেন লজি বেগম।
তিনি বলেন, ১৯৯৩ সালে ৮ম শ্রেণীতে পড়াশুনা করা অবস্থায় প্রতিবেশী যুবক শহিদুল ইসলামের সাথে তার বিয়ে হয়। শহিদুল তখন ১০ শ্রেণীর ছাত্র। কোন কাজকর্ম নেই। একেবারে বেকার। স্বামী ছাত্র হওয়ার কারণে সংসার জীবনের শুরুতেই শ্বশুরের ওপরে সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হতে হয়। লেখাপড়া তেমন না জানলেও লজি বেগমের বৃদ্ধিমত্ত্বা ছিল প্রখর। যে বয়সে চুড়ি ফিতা আলতা ইত্যাদির মোহে বিভোর থাকার কথা, কিন্তু সেই বয়সে সংসারের বিভিন্ন সমস্যা উত্তরণের উপায় খুঁজতে থাকেন লজি।
বিয়ের এক বছরের মাথায় নিজের সঙ্গে থাকা খুবই সামান্য টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। কাঁচা হলুদ কিনে সেদ্ধ করে শুকিয়ে গুড়া করে গ্রামের বাজারে বিক্রি করতে থাকেন। এই ব্যবসার আয় থেকে স্বামীর পড়ার খরচের খানিকটা মেটাতে পেরে তার আনন্দ আর ধরেনা। স্বামীর এসএসসি পাশের পর লজি বেগম তাকে নারিকেলের ব্যবসা করতে উদ্বুদ্ধ করেন। মাঝে মধ্যে অবিক্রিত নারিকেল নিয়ে স্বামী বেচারা যখন বিপাকে পড়তেন লজি বেগম তখন ওই নারিকেল বাড়িতে এনে ভাঙিয়ে তেল বানিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করতেন। এসব ব্যবসা থেকে যা লাভ হতো তা দিয়ে কোন রকমভাবে সংসার চলতো তার।
এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে মা হন লজি বেগম। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে লজি বেগম বলেন, সন্তান হওয়ার পর সন্তানকে দুধ কেনার টাকা ছিল না তার। অভাবের কারণে কেউ তাদের কাছে দুধও বিক্রি করতো না, যদি টাকা না দিতে পারি এটা ভেবে। এমনও দিন গেছে দুধের বোতলের ভেতর ভাতের মাড় ভরে ছেলেকে খাইয়েছেন। এরপর ৯৯ সালের দিকে শুধুমাত্র ছেলেকে দুধ খাওয়ানোর জন্য চড়া সুদে স্থানীয় এনজিও থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে একটি দেশী জাতের গাভী কেনেন। ওই গাভী থেকে ১ থেকে ২লিটার দুধ হতো। ছেলেকে দুধ খাওয়ানোর পর অতিরিক্ত দুধ বিক্রি করতেন বাজারে। এক সময় তার মাথায় উন্নত জাতের গাভী কেনার চিন্তা আসে। যে চিন্তা সেই কাজ। ২০০০সালে ওই গাভী ও গাভীটির বাচ্চা বিক্রি করে ৮৫হাজার টাকা দিয়ে একটি উন্নতজাতের গাভী ক্রয় করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি তাকে। ওই গাভী দিয়েই তার পালে গাভী বাড়তে থাকে। সেই সাথে হাঁস মুরগী ও ছাগল পালন করেন। যথারীতি দুধ ডিম মাংসের জন্য একজন নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী হিসেবে লজি বেগমের নাম আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে প্রাণি সম্পদ দপ্তর থেকে নেন নানা রকমের প্রশিক্ষণ। গাভীর চিকিৎসা, ভ্যাসকিন সবই করেন নিজ হাতে। এছাড়া গাভীর ডেলিভারী করেন তিনি নিজেই। তিনি শুধু নিজের খামারের নয় এলাকার যতো গরু আছে সেগুলোর ভ্যাকসিন ও ডেলিভারী তিনিই করেন। এক পর্যায়ে তার খামারে গাভীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৩৪টিতে দাঁড়ায়। এসব গরু থেকে প্রতিদিন প্রায় ২শত লিটার দুধ বিক্রি করেন তিনি। তার ভাষ্যমতে ওই সময়ে খরচ বাদে প্রতিমাসে তার আয় হতো ৭৫হাজার টাকা। এভাবে আয়ের টাকা ও গরু বিক্রি করে মাঠে ২ বিঘা ও বাড়ীর শরীকদের কাছ থেকে সাড়ে ১৮শতাংশ জমি ক্রয় করেন। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় কোটি টাকা।
এছাড়াও তিনি খামারের গবর থেকে গ্যাস উৎপাদনের লক্ষ্যে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করেন। এই বায়োগ্যাস থেকে নিজের রান্নাবান্নার সব কাজ সারেন। সমুদ্রে যেমন জোয়ার ভাটা আসে, তেমনি লজি বেগমের জীবনেও জোয়ার ভাটা আসে। মাঝে ৫টি গাভী মারা যায়। আর বেশ কিছু গাভী ম্যাসটাইটিস রোগে আক্রান্ত হলে লসে সেগুলো বিক্রি করতে বাধ্য হোন। যার কারণে খামারে গাভীর সংখ্যা একেবারেই কমে যায়। বর্তমানে তার খামারে ৪টি বড় গাভী, ৪টি বাছুর ও ১টি বকনা রয়েছে।
লজি বেগম বলেন, ২০১৩ সালে কৃষি উন্নয়নে উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সেই পুরস্কার গ্রহণ করেছি। এছাড়া ২০১৪ সালে নারী ক্যাটাগরীতে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনকারী হিসেবে রাজবাড়ী জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার পান।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সরকারের কাছ থেকে শুধু সার্টিফিকেটই পেয়েছি। কিন্তু কখনো আর্থিক সহযোগিতা পাইনি। এমনকি কোন ব্যাংক স্বল্প সুদে আমাদের লোন দেয়নি। এগুলো যদি পেতাম তাহলে আরো এগিয়ে যেতে পারতাম।
তিনি বলেন, ইচ্ছা আছে যদি স্বল্প সুদে ব্যাংক লোন পাই তাহলে খামারটি আবারো বড় করবো।
লজি বেগমের স্বামী শহিদুল ইসলাম বলেন, এক সময় সংসারে অভাব ছিল। এখন আর অভাব নেই। দিন পাল্টে গেছে। সুদিন ফিরিছে। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে আমার স্ত্রী লজির কারণে। আমি শুধু তাকে সহযোগিতা করেছি।
+ There are no comments
Add yours